
কি মনে হল, রিডিং টেবিলের কাছে থেমে গেলো । টেবিলের ডান দিকে তিনটি ড্রয়ারের মাঝেরটা থাকে মাঝারি সাইজের প্যাড আর একটা কলম বের করল । কি কি করবে তার একটা লিস্ট করে ফেললো ঝটপট । ওয়ারড্রপ খুললো, আজ শাড়ি পরবে । কোনদিন শাড়ি পরেনি ‘মায়া’ কিন্তু আজ পরবে । এবার শুরু হল আসল যুদ্ধ কালার সিলেকশন নিয়ে, একটা করে হাতে নিচ্ছে খুলছে আর বেডের উপর ফেলছে । হঠাৎ মনে হল সকাল থেকে ফ্রেশ হওয়া হয়নি, ব্রাশের উপর হালকা পেস্ট লাগিয়ে দৌড় দিল ওয়াশ রুমের দিকে ।
আকাশ ফেড়ে লাল আগুনের গোলার মত সূর্যটা
আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে । ‘মায়া’ শাড়ি পরা শুরু করলো , চৌড়া লাল পাড় আলা
সাদা শাড়ি । সবই মোটামুটি হোল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কুঁচি দিতে পারছেনা ।
কারো হেল্প নিতে আজ তার ইচ্ছে করছেনা । তো কোন রকম সে শাড়ি পরা শেষ করে
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসলো । আয়নাতে নিজেকে দেখে চমকে উঠল , আজ
অসম্ভাব সুন্দর লাগছে তাকে । নিজেকে কখনো এভাবে আবিষ্কার করেনি ‘মায়া’।
শাড়ির সাথে মিল করে লাল কালারের চুড়ি পরেছে হাতে । লিস্ট আনুসারে সব জিনিস
এখনো বারান্দাতে আনা হয়নি । ফ্রিজ থেকে একটুকরা কেক নেয়া হোল সাথে একটা
ক্যান্ডেল । এ সুন্দর মুহূর্তটা ফ্রেমে বন্দি করে রাখার জন্য আলমারি থেকে
ক্যামেরা আনা হয়েছে । কিন্তু সূর্য আর বের হয়না । মনে হচ্ছে পৃথিবীর সকল
পাপ যেন সত্যকে আড়াল করে ফেলেছে । ‘মায়া’র মেজাজ চরম খারাপ । বাম হাতে
জ্বলন্ত ক্যান্ডেল আর ডান হাতে ছুরি নিয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে
আছে । তার ইচ্ছে করছে ছুরি দিয়ে মেঘটার মাঝখান দিয়ে ফেড়ে সূর্যটাকে বের করে
আনতে । এদিকে দরোজাই কড়া নড়ছে ______
‘আপা ওঠেন ___ আম্মাই আপনারে ডাকে ।কিছুক্ষণ পর ‘মায়া’ দরোজা খুলে বের হয়ে ড্রাইনিং টেবিলের দিকে গেলো । চেহারা উস্কসুস্ক , সামনের চুলগুলো দু-দিকের দুগালের উপর নেতিয়ে পড়েছে । মায়ার মা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ______
‘এত সকালে শাড়ি পরেছ কেন?’ __ আর পরেছ ঠিক আছে , কিন্তু টিপ পরনি কেন?
‘মায়া’ কোন কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ নাস্তা শেষ করে নিজের ঘরে চলে এলো । তার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে । ওয়াস রুম থেকে শাড়ি চ্যেন্জ করে সেলয়ার কামিজ পরল , একটা বড় টিপও পরল। আজকে তার ইউনিভারসিটিতে যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না তারপরেও কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল । রাস্তাই বেরিয়ে প্রতিদিনের মত কোন রিক্সা নেই । যথারীতি মোড়ের উপর চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা পাড়ার ছেলেগুলো ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছে এদিকে । বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রিক্সা এসে থামল মড়ের কোনাই । ‘মায়া’ হাত ইশারা করতেই চায়ের দকানের ছেলেগুলো নানা রকম পোঁচ দেওয়া শুরু করল । কেউ পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে এটে সেটে দাঁড়াচ্ছে । কেউ আবার পিছনের পায়ের উপর ভর করে সামনের পা টা একটু বাঁকা করে বিদঘুটে একরকম অঙ্গভঙ্গি করছে । এসব চার্লিদের দেখে মায়ার মেজাজ আর হট হয়ে যাচ্ছে । সে রিক্সাই উঠে চালককে হুড টেনে দিতে বলে ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলো । ফোনের কন্টাক লিস্ট বের করে চিন্তা করছে কাকে কল করলে মেজাজটা একটু ঠাণ্ডা হবে । রিক্সা চালক আপন মনে সিগারেট টানতে টানতে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে । আদিখ্যেতা মার্কা কথা সুনতে মায়ার একদম ইচ্ছে করছে না । তাই চালকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো _____
মামা তুমি কি সিগারেট খাও ?
__আপা সিগারেট খাই না। বিড়ি খাই, আজকে এখনো ভাল ইনকাম হয়নাই। ভাল হইলে বেন্সন খামু ইনশাল্লাহ ।
কোন ব্রান্ডের বিড়ি খাও ?
__ আকিজ। তয় সব কোম্পানিরই চলে, যহন যেডা পাই ।
বিড়ি খেলে কি মেজাজ ভাল হয় ?
__ এইডা নির্ভর করতাছে মেজাজ কতটা খারাপ তার উপর ।
মায়া কর্কশ কণ্ঠে চালকের পিঠে টোকা দিয়ে বলল, ‘মামা একটা বিড়ি দেন।’ রিক্সা চালক পিছন ফিরে অবাক হয়ে চোখ বড়করে কিছু জানার ভঙ্গী নিয়ে তাকিয়ে বলল__ ‘আপা আরত নাই, এই একটাই আছে।’ ‘ঐটাই দেন’__ বলে রিক্সা চালকের কাছথেকে অর্ধেক বিড়ি নিয়ে সমানে টানতে লাগল। সাধারণত মানুষ প্রথম-প্রথম সিগারেট বা বিড়ি খাওয়া শুরু করলে প্রথম টানের ধোঁয়া ভিতরে যাওয়ার সাথে সাথে কাশতে শুরু করে। কিন্তু মায়ার ক্ষেত্রে এমন কোন কিছুই ঘটল না। নিজেকে আজ তার পৃথিবীর সবচাইতে বড় ধোঁয়া খোর মনে হচ্ছে। কিন্তু টেনশনের ব্যাপার হোল মেজাজ বাবাজী ঠাণ্ডা হওয়ার কোন নামই নিচ্ছেনা। রাস্তার পাশে একটা বড় মেগাসপের দিকে হাত ইশারা করে রিক্সা থামাতে বলল মায়া। ভাড়ার সাথে আরও দশ টাকা এক্সট্রা দিয়ে বলল, এইটা দিয়ে একটা বেন্সন সিগারেট কিনে খাবেন।’
‘মায়া’ ধাক্কা দিয়ে মেগাশপের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। এসির ঠাণ্ডা বাতাসে বাইরের গরমের ঘিনঘিন ভাবটা শরীর থেকে অনেক অংশে কেটে গেলো। এখন কাস্টমারের খুব একটা চাপ নেই, কয়েকজন মানুষ এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরছে। মায়ার পায়ের নুপুরের হালকা মৃদু আওয়াজ চারদিকের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো স্টেশনারি সেকশনের দিকে। বুক শেল্ফ দেখে মনে হোল এখন আর বই কেনা হয়ে ওঠে না, কোন বই পড়ার ইচ্ছে হলে ই-বুক থেকেই পড়া হয়। বুক শেল্ফ থেকে কিছু বই, একটা ফাউন্টেন পেন সাথে কিছু বিভিন্ন কালারের প্যাড এবং একটা ম্যাজিক বোর্ড তার হাতে রাখা ঝুড়িতে তুলে নিল। কস্মেটিক্স শেল্ফ থেকে কিছু মেকাপের জিনিস নিয়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলো।
‘মিশু’ আজ সকাল থেকেই অনেক ব্যাস্ত। তাড়াতাড়ি করে নিজেনিজে সেভ করতে গিয়ে গালের কয়েক যাইগাইয় স্লাইড ঝেড়ে দিলো। হালকা ব্লিডিং হচ্ছে। সে নিজেয় নিজেকে বোঝাচ্ছে, আরে এইটা কোন ব্যাপার না। হাতে সামান্য তুলা নিয়ে গাল ধরে বাড়ি থেকে বের হোল ‘মিশু’। রাস্তায় যার সাথেই দেখা হয় সেই জিজ্ঞেস করে, ‘আরে মামা কি হয়েছে?’ সে কোন কথার উত্তর দেয় না খালি মুচকি হাঁসি দিয়ে পাশকাটিয়ে বেরিয়ে যায়। এই ‘মিশু’ হচ্ছে এক আজব ক্যারেক্টার, দেখতে-শুনতে খুব একটা খারাপ না। প্রায় ছয় ফুটের মত লম্বা, গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা। চুল সব সময় স্পাইক করে রাখে। একবার কি হোল। সাত-আট বছর আগের কথা, এক বর্ষার সকালে সাইকেল নিয়ে বেরহোল স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাস্তার উপর বিভিন্ন জাইগাইয় পানি জমে আছে, কোথাও কোথাও আবার ড্রেন আর রাস্তা এক হয়ে গেছে। কোনটা ড্রেন আর কোনটা রাস্তা চেনা যাচ্ছে না। সে মেন রাস্তা থেকে একটা গলিতে ঢুকে গেলো শর্টকাট মারার জন্য। কিছু দূর যাওয়ার পরই ঘটলো তার জীবনের ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনা গুলোর মধ্যে একটি। ধপাস করে একটা শব্দ সাথে মা গো বলে চিৎকার। অর্ধেক সাইকেল ড্রেনের মধ্যে, প্যান্ট সহ সমস্ত পায়ে ময়লা কাদা মেখে গেলো। কোন রকমে সাইকেলটা তুলে ঠেলতে ঠেলতে হাটা শুরু করলো। স্কুলের পুকুরে নেমে প্যান্ট সহ হাত-পা ভাল করে পরিস্কার করলো। তারপর সাইকেলে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। এবারি বোঝেন সে কত বড় বুদ্ধিজীবী, স্কুলে পরিষ্কার পরিচ্ছন হয়ে ক্লাস না করে বাড়ি চলে আসল।
‘মিশু’ জানালা দিয়ে অনেক ক্ষণ ধরে পাসে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইভেট কারের মাঝে বসা সাত বছরের এক পিচ্চি ছেলের কার্যকলাপ দেখছে। বাসটা দশ মিনিটের উপরে জ্যামে আটকে আছে। পিচ্চি ছেলেটা ফ্রেমে বাধানো সাদা একটা বোর্ডের উপর ডান হাত দিয়ে হিজিবিজি লিখছে আর নিচের দিকে বাম হাত দিয়ে কি যেন টান দিচ্ছে সব মুছে যাচ্ছে। আবার লিখছে টান দিচ্ছে আর সব মুছে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ‘মিশু’র কাছে চরম মজা লাগছে। যদিও এটা সবার কাছে অতি পরিচিত ম্যাজিক বোর্ড, কিন্তু মিশুর কাছে পুরায় অপরিচিত একটা ব্যাপার। সে বাস থেকে নেমে হাঁটা ধরল, আজ তাকে ম্যাজিক বোর্ড কিনতে হবে।
বেডের উপর শপিং ব্যাগ পড়ে আছে। মায়া আয়নার সামনে বসে চিরুনি দিয়ে চুলে ব্যাক ব্রাশ করছে আর বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে নিজেকে দেখছে। আয়নার ভিতর নিচে কনার দিকে শপিং ব্যাগটার দিকে চোখ পড়তেই ঠটের কনায় হাঁসি আর চেহারায় খুসির ছায়া ফুটে উঠল তার। আয়না থেকে ঘুরে পিছন ফিরে উঠে বেডের উপর গিয়ে বসলো। ব্যাগের মুখ খুলে একটা একটা করে জিনিস বের করতে থাকল। সে খুব এক্সাইটেড, ম্যাজিক বোর্ডটার উপর চোখ আটকে গেলো। শক্ত পলিথিনের কাগজে মোড়ান সাথে কলমও আছে লেখার জন্য। মায়া সাবধানে পলিথিনটা খুলতে আরাম্ভ করলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাবধানতা বজায় থাকলনা। কাগজটা ছিড়ে গেলো, তাতে কি হয়েছে বোর্ডের তো কিছু হয়নি। সে বোর্ড হাতে নিয়ে চিন্তাই পড়ে গেলো কি লিখবে। এখানে প্রথম লেখা অবশ্যই অসাধারন কিছু হতে হবে, কিন্তু কি সেটা। একটু অন্য মনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চিন্তা করছে।
মিশু হাটতে হাটতে বাসায় পোঁছে গেলো। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তাই কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। কোন রকমে হাতে মুখে পানি দিয়ে ম্যাজিক বোর্ডটা নিয়ে বসে পড়ল। খুব স্বজতনে জিনিসটাকে আবরন মুক্ত করলো। পড়ার টেবিলের উপর বোর্ড রেখে চেয়ারটা বাম হাত দিয়ে টানতেয় চোখ পড়ল বোর্ডের সাদা অংশের উপর। পেন্সিল কালারে স্পস্ট ভাবে লেখা__ ‘কি লিখব’। হালকা ভুরূ কুচকে গেলো, চরম রাগ হচ্ছে মিশুর ‘টাকা দিয়ে কি পুরাতন বোর্ড কিনে আনলাম’। আজ দোকানদারের একদিন কি তার একদিন, বোর্ডটা প্যাকাটে ঢুকানর প্রস্তুতি চলছে। এরকম সময় আচমকা লেখাটা আস্তে আস্তে মুছে গেলো। হালকা ঝাটকা মেরে বোর্ডটা একটু দূরে ছুড়ে ফেললো, রিতিমত ভয় পেয়ে গেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোর্ডের দিকে আবার কিছু হয় কিনা দেখার জন্য। প্রায় মিনিট খানেক পর আবার বোর্ডের উপর লেখা উঠতে শুরু করলো___
সন্ধ্যাতারা …… আমি, আর ……… তুমি ??
মিশুর ভয় ভয় ভাব এখনো কাটেনি তার পরেও অল্প সাহস সঞ্চার করে কলমটা দিয়ে বোর্ডের উপর দুটো খোঁচা দিলো, কিছুই হচ্ছে না। এবার হালকা কাঁপা কাঁপা হাতে বোর্ডটা তুলে নিচের হ্যান্ডেল ধরে টান দিলো।
মায়ার হাতে ধরা বোর্ড থেকেও সব মুছে যাচ্ছে। সে খুব সাহসী মেয়ে, খুব সহজে ভয় পায় না। বোর্ডটা উল্টা পাল্টা করে ভাল ভাবে চেক করলো, না কোন সমস্যা নেই। তাহলে সব মুছে গেলো কি করে? কারণটা উদ্ধারের জন্য আবার লেখল__ ‘কে”। এবার ‘কে’ মুছে আস্তে আস্তে উঠতে থাকল
– আপনি কে?
– আগে বলুন আপনি কে?
ব্যাপারটা দুজনের কাছে বেস ইন্টারেস্টিং লাগছে। তারা ম্যাজিক বার্তা আলাপন চালিয়ে যেতে লাগল__
– আমি মিশু।
– আপনি?
– আমি মায়া।
– মায়া …… অসম্ভব সুন্দর নাম।
তাদের কথপকথন চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেন মনে হচ্ছে পৃথিবী থেকে অন্য কোন ভুবনে চলে গেছে। যে ভুবনে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।
বাইরে কখন যে বৃষ্টি শুরু হয়েগেছে একটুও টের পায়নি মায়া। বৃষ্টি তার খুব প্রিয়। জানালা দিয়ে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। গায়ের লম খাড়া হয়ে যাচ্ছে বাতাসে। তার পরেও বেড থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না আজ। মনেহচ্ছে কে যেন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। বোর্ডে লেখা উঠছে__
– আমরা কি দেখা করতে পারি না?
– হুম, পারি। কবে করতে চান?
– কাল।
– ওকে ডান।
– কিন্তু কথায়?
– মসজিদ রোডের পাসে বড় মাগাশপটা থেকে সামনে গেলে যে পার্কটা, ওখানে।
মিশু আনান্দে লাফাতে শুরু করলো। কিন্তু তার এই আনান্দ বেশিক্ষণ স্তায়ি হল না। এক্সসাইটিং হয়ে হ্যান্ডেল্টা ধরে টানদিতেই বোর্ডের কোনা হালকা চটে গেলো। মিশুর কনদিকে খেয়াল নেই, অন্য রকম এক ঘোরের মধ্যে আছে সে। সমস্ত জগতটা তার কাছে ছোট হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে মেঘের উপরে ভেসে চলেছে অজানার উদ্দেশে। অনেকটা নেশা করলে যেরকম হয় ঠিক সেরকম। কিন্তু পার্কে যেয়ে চিনবে কি করে ‘মায়া’কে? তাকে তো কোন দিন দ্যাখেনি। আবার হন্তদন্ত হয়ে বোর্ডটা হাতে নিয়ে লিখতে আরাম্ভ করল, ‘আমিতো তোমাকে কখন দেখিনি, তাহলে চিনবো কেমন করে?’ এবার আর লেখা মুচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে মিশু। নিচের হ্যান্ডেল ধরে বারবার এদিক ওদিক টানাটানি করছে। কিন্তু কোনকিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
ওদিকে মায়াও চেষ্টা করছে, ‘কি হল, তাহলে কি ওর সাথে দেখা হবে না?’ ওদৃশ্য একরকম কষ্ট মায়াকে ঘিরে ধরে অট্ট হাঁসি হাসছে। কেউ যেন বুকের উপর বড় পাথর রেখে দিয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও সরানো যাচ্ছে না।
মিশুর সমস্ত শরীরের রক্ত মাথাই উঠে আসছে। কান মাথা লাল হয়ে গেছে। কপাল, নাক মুখ আস্তে আস্তে ঘামতে শুরু করছে। সে ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিছু মানুষ থাকে যাকে না দেখেও তার অনুভূতি সব সময় নিজেকে বিচলিত করে রাখে। এটা আসলে কি? ভাললাগা, নাকি ভালবাসা, না মনের টান ………… মনে হয় এটাই মায়া। আর কিছু ভাবতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না।
মিশু, রোবটের মতো জামা পোরে হাতে মাজিক বোর্ডটা নিয়ে নির্বোধের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। বারবার হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুচ্ছে। এতদিন নিজেকে স্বার্থপর মনে হত, আজ পৃথিবীটাকে মনে হচ্ছে। চারপাসের সব কিছু কেমন যানি ঘুরছে। রাস্তাই নেমে কোন যানবাহন না পেয়ে দৌড়াতে আরাম্ভ করলো। দোকানদার বলেছিল সন্ধায় নতুন মাল আসবে। মায়ার কাছথেকে জানতে হবে কখন আসবে, কোন রঙের কাপড় পরবে? শাড়ী পরবে না অন্য কোন পোশাক পরবে? সে আরও দ্রুত দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ থেমে গেলো। মেগাসপের সাটারে তালা, কেউ নেই ওখানে। বোর্ডটা ধরে বসে পড়ল মিশু।
আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজ। মায়া লাইট ওফ করে জানালা খুলে শুয়ে আছে একা একা। চাঁদের আলো এসে পড়ছে তার সারা গাঁয়ে। কিন্তু সে আলো কষ্ট ভেদ করে মায়ার মনকে পারছে না ছুয়ে দিতে।
সে রাতে দুজনের একজনও ঘুমাতে পারল না।
সকাল হওয়ার সাথে সাথে মিশু রেডি হয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়ল হাতে বোর্ডটা নিয়ে। যে করেই হোক বোর্ডটা চেঞ্জ করে ‘মায়া’র সাথে যোগাযোগ করতে হবে, ও বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই। সে মেগাসপের সামনে বসে আছে অধির আগ্রহে, শপ খোলার অপেক্ষাই। প্রায় দু-ঘণ্টা পর শপের সাটার ওপেন হওয়ার সাথে সাথেই দিনের প্রথম দুঃখের সংবাদ পেয়ে গেলো। কাল কোন মাল আসেনি। মিশু শপ থেকে বেরিয়ে হাটতে থাকল দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পার্কের দিকে।
নীল কালারের হাতে কাজ করা জামদানি শাড়ী পরা একটা মেয়ে বসে আছে পার্কের কোনাই বড় ঝাউ গাছের নিচে রাখা বেঞ্চের উপর। মেয়েটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর। গায়ের রং ফর্শা, মাথার লম্বা চুলগুলো কুচকুচে কাল। চোখ গুলো টানা টানা, দেখতে একেবারে ইরানী মেয়েদের মতো। শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করে কপালে নীল টিপ পরেছে। চুলগুলা খোলা, ঝিরিঝিরি বাতাসে কানের দুপাস দিয়ে হালকা হালকা উড়ছে। পাসে বেশ কিছু ফুল রাখা আছে। মিশু যেয়ে বেঞ্চের এককোনায় বসলো। মেয়েটি অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। মিশু মুখ তুলে পাশে তাকাতেই ফুলের নিচে রাখা ম্যাজিক বোর্ডটার উপর চোখ পড়ল। চোখ বড় বড় করে চমকানোর ভঙ্গিতে বলে উঠল,
– ‘মায়া’ ……………
মেয়েটি মিশুর দিকে তাকিয়ে হতবম্ভ, কিছুই বলতে পারল না। শুধু ঠোঁটের কোনাই একটা মিষ্টি হাঁসি ঝিলিক দিচ্ছিল।
কিছু সৃতি অমলিন, কখনো ভলা যাই না। আজ অনেক বছর পর পার্কের ঐ বেঞ্চে আবারো দুজন। ম্যাজিক বোর্ডের রহস্য টা আজ অব্দি রহস্যই রয়ে গেছে। অতীত মানুষকে কখনো আনান্দ দেয়, কখনো বা বেদনা।
By Omar Faruk
0 comments:
Post a Comment